Thursday, June 9, 2016

জামাইবাবু জিন্দাবাদ

আগামীকাল জামাই ষষ্ঠী। বাঙালি হিন্দুর বার্ষিক জামাইবাবাজির মহিমা কেত্তন উদযাপন। মাছ এবং আমের দাম বাড়বে। মিষ্টির দোকানে ভাইফোঁটার চেয়ে সামান্য ছোট লাইন পড়বে আর সকাল থেকেই ট্রেনে মাঞ্জা মেরে দম্পতিরা এন্ডাবাচ্চা সহ গৃহিণীর পিত্রালয়ে যাত্রা করবেন। জামাইষষ্ঠী পিতৃতান্ত্রিক অনুষ্ঠান না নয়, আজকের লেখার বিষয় সেটা নয়। অতীতের সমবয়সী শাশুড়ি-জামাই-এর মধ্যেকার রসালো প্রণয়কাহিনীও নয়। বিষয় হলো গিয়ে সিনেমা। মায়ের কাছে শুনেছি, তাদের অগুনতি জামাইবাবুরা জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যে শ্বশুরবাড়ি এসে কব্জি ডুবিয়ে পেটপুজো করা ছাড়াও আরেকটা কাজ প্রায় রুটিন মেনেই করতেন - শালিবাহিনী নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া। দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে, শালিরা যে যার মতো অর্গানজা, পিওর সিল্ক, আফগান স্নো, তুহিনা লোশনে সেজেগুজে রিক্সা ডেকে মানসী, নির্মলা, যমুনা এইসব নামের হলে, ব্যালকনির টিকিট কেটে চিনেবাদামের ঠোঙা হাতে ঢুকে পড়ত। ঘন্টা দুয়েক ঠেলাঠেলি করে হেসে, নায়কের দুঃখে রুমাল ভিজিয়ে, কাজল ধেবড়ে বেরিয়ে কোনো কেবিনে চপ কাটলেট কিম্বা মোগলাই পরোটা কষা মাংস ভাগাভাগি করে খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে সন্ধ্যে কাবার করে বাড়ি।

সারা বছর বাড়ির মেয়ে বৌদের সিনেমা দেখতে হলে সাধারণত বাবা কাকা শ্বশুর শাশুড়িদের লুকিয়ে করতে হতো। বড় মাইমার ছোটকাকু চাকরিক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে বৌদিদের সিনেমার টিকিট কেটে দিয়েছিল। দুপুরের দৈনিক দু ঘন্টার গেরস্থালীর ছুটির সময়ে তারা দল বেঁধে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে পারলেও, ফেরার সময় শাশুড়ি ঠাকরুণের হাতে ধরা পড়ে যায়। ছোটকাকার কপালে মায়ের হাতের সপাট থাপ্পড় জুটেছিল। আর জাঁদরেল শাশুড়ি ঠাকরুণ মহাশয়া কোচওয়ান ডেকে বাগানবাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। পরে সব ছেলেরা মিলে গিয়ে পায়ে পড়ে বৌদের শাসন করার অঙ্গিকার করলে তিনি আবার ফেরেন। পাঠকগণ এটুকু ডাইগ্রেশন নিজগুণে মাফ করবেন আশা করে গল্পটা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

তো যাই হোক, সিনেমা দেখা বিশেষ করে বাড়ির মেয়ে বৌদের সিনেমা দেখা বরাবরই গর্হিত কাজ। শুধু বছরের এই একটা দিনে (জামাই ষষ্ঠী) কারুর মুখে সিনেমা দেখার কথা শুনে অসন্তোষের সামান্য ছাপটুকুও দেখা যেত না। জামাইবাবু-শালীর সম্পর্কের দুষ্টুমি খুনসুটির মধ্যেকার বন্ধুত্বের, যৌনতার মিশেলে, গায়ে গায়ে বসে নায়ক নায়িকার প্রেম দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে এক ধরণের মাদকতা ছিলই, যা হয়তো আজ এই ২০১৬ সালে বসে খুব মাথা খাটিয়েও শব্দের বাঁধুনিতে ধরতে পারব না।

আমরা একবারই জামাইবাবুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছি। ওদের বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠীতে। কল্যাণী সিনেমা হলে শাহরুখ খানের দেবদাস। হলের জঘন্য সাউন্ড সিস্টেমের কল্যাণে ৭০% ডায়ালগ বুঝতে না পারলেও, শাহরুখের দুঃখে দিদির চোখের জলে নাকের জলে হয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফোঁত ফোঁত-এর আবহে আর ভনসালির শাড়ি গয়নার চোখ ধাঁধানিতে মিলিয়ে মিশিয়ে মনে মনে জামাইবাবু জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিলাম বৈকি!

Monday, March 28, 2016

নারী মাত্রেই অপ্সরা আর পুরুষ মাত্রেই ধ্যানমগ্ন ঋষি

বাচ্চালোগ, একটা কথা বুঝুন। আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে চুইং গাম, কন্ডোম, সর্ষের তেল, ল্যাপটপ, গাড়ি, বাচ্চাদের সাবান, বাড়ির রঙ, সবকিছু বেচতেই একটা নারীশরীর লাগে। পুরুষের ডিওস্প্রে বেচতেও আকাশ থেকে খসে পড়তে হয় কয়েক পিস সুন্দরী, পাখনাধারী পরী হুরীকে। পুরুষের সমস্যা হলো, তার হাতে ক্ষমতা, প্যান্টের zip এর ভেতরে শিশ্ন, মুখে মা মাসি থাকলেও, দেহে খাঁজ ভাঁজ নেই। এদিকে আবার বাকি জিনিসের মতোই, খবরের কাগজ আর ওয়েবসাইটও বাজারে বিক্রি করতে হয়। সেই বাজারেই, যে বাজারে মেয়েছেলের চেয়ে দামী পণ্য আর নেই।

এবারে ধরা যাক, খেলার পাতার ম্যাড়ম্যাড়েত্ব কাটিয়ে, তাকে প্রাণোচ্ছল করার তাগিদ থেকে, পুরুষ খেলোয়াড়দের ছবি ছাপলেই তো শুধু চলে না, তাদের সুন্দরী WAG দের ছবিও ছাপতে হয়। WAG জানেন না? Wives and girlfriends। বিদেশে, প্রতিটা বড় টুর্নামেন্ট-এর কভারেজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই WAG রা। ফুটবল থেকে টেনিস, কোনও খেলাই এই প্রথার বাইরে নয়। ম্যাচ চলাকালীনও ক্যামেরা ঘুরে ঘুরে রেগুলার ইন্টারভ্যালে একবার করে এঁদের শ্রীমুখ ও শ্রীতনু আমাদের দর্শন করাবেই। তবে ওয়াগ যদি হয় শাহিদ আফ্রিদির গিন্নীর মতো সর্বাঙ্গ বোরখায় ঢাকা কোনো মহিলা, তাহলে অবশ্য ব্যপারটা স্লাইটলি অন্যরকম হবে।

এবারে ভাবুন তো, ভালো করে ভেবে বলুন, মেরি কম, মালেশ্বরী কারনাম, সাইনা নেহওয়াল, জোয়ালা গাট্টা - এদের বর/প্রেমিকের নাম আপনি জানেন? মানে এক লহমায় গুগল না করেই বলে দিতে পারবেন? পারবেন না তো! কোনও মহিলা খেলোয়াড়ের বরের নাম বলতে পারবেন? হ্যাঁ সানিয়া মির্জার বরের নাম মনে পড়েছে। তাও কিনা সে শত্রুপ্রদেশ পাকিস্তানের ক্রিকেট প্লেয়ার বলেই। এবারে মনে করে দেখুন তো সানিয়া মির্জার খেলার খবরে কবার শোয়েবের ছবি দেখেছেন? মনে পড়ছে না তাই তো? বিশেষ দেখেননি। মানে দেখার কথাও নয়। শোয়েবের আর যাই থাক, ক্লিভেজ নেই। তাছাড়াও, সানিয়ার হারের জন্য শোয়েব হারামজাদাই দায়ী, এ কথা বলতে পুং সমাজের বুকে বাজবে। বাড়ির বৌকে মাঠে ছোট স্কার্ট পরে খেলতে পাঠিয়েছে এই কি কম কথা?

যাকগে, এইবারে আসা যাক অনুষ্কার কথায়। অনুষ্কা এমনিতেই সিনেমার নায়িকা। আর এ কথ আমরা সকলেই জানি, যে সিনেমার নায়িকা = 'বাজারের মেয়েছেলে'। ওরা ক্যামেরার সামনে ছোট জামা পরে নাচে, পরপুরুষকে জীবিকার স্বার্থে চুমু খায়, সফল ক্রিকেটার, বড়লোক ব্যবসায়ী দেখলেই তক্কে তক্কে থাকে, ছলে বলে কৌশলে তাকে বশ করবে বলে। এ হেন অনুষ্কা শর্মার বাপের ভাগ্যি ভাল যে তাকে বিরাট কোহলির মতো সুপুরুষ ক্রিকেটার পাত্তা দিয়েছে। আর শুধু পাত্তা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, তাকে মাঠে/ট্যুরে সঙ্গে নিয়েও গেছে। এখন অবশ্য প্রেমটা ভেঙে গেছে। কিন্তু তাতে কী? শুকনো মুখে ক্রিকেটের সমালোচনা করতে আর কাঁহাতক ভালো লাগে বলুন? তার চেয়ে একটু মশলা ছড়িয়ে নেওয়া যাক। বিরাট খারাপ খেললে, অনুষ্কা বিষকন্যা। ভালো খেললে, তাকে দুয়ো দিয়ে বলা যায় 'দেখলি তো! পুরুষ সিংহ এমনই হয়। প্রেম ট্রেমের মতো ঠুনকো ব্যপার নিজের কাজকে প্রভাবিত করতে দেয় না। দ্যাখ কেমন সুপাত্র খোয়ালি।' শোনা যায়, অনুষ্কা শর্মা ছবি প্রতি পাঁচ-ছ কোটি টাকা রোজগার করেন বলিউডি নারী-পুরুষ রোজগারের বৈষম্যের বাজারেও। তবে তাতে কী? এই ধরাধামে নারী মাত্রেই অপ্সরা, আর পুরুষ মাত্রেই ধ্যানমগ্ন ঋষি, কলিযুগে যাঁরা বিরাট কোহলি অবতারে জন্মগ্রহণ করেন।

Monday, March 14, 2016

নারদ নারদ!

ঘটনাবলি 

নারদ নিউজ সংস্থার শুট করা একটা ভিডিও আজ প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে তারা ভিডিও শুট করা শুরু করে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে লুকনো ক্যামেরার সামনে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতামন্ত্রি টাকা নিচ্ছেন। যে ভিডিওটা ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে, তার শুটিং-এর সময়কাল ২০১৪। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে। যেকোনো ভোটের আগেই যে ভারতের বাজারে আক্ষরিক অর্থেই টাকা উড়ে বেড়ায়, এ কথা আমরা মোটামুটি জানি। সমস্ত রাজনৈতিক দলই যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কর্পোরেট দুনিয়ার কাছ থেকে মোটা টাকা 'চাঁদা' পায় তাও অজানা নয়। বাস্তবিক, একটা র‍্যালি করতে শুধু যে পরিমাণ পেট্রল খরচ হয়, তার অংকই কয়েক লাখ। এ ছাড়া স্টেজ, মাইক, খোরাকি, হেলিকপ্টার ইত্যাদি তো আছেই। বেচারা দলগুলোর কোনও দোষ নেই। একটা ঠিকঠাক প্রচার ক্যাম্পেন নামাতে যে কোনো দলই কয়েক শো কোটি টাকা খরচ করতে বাধ্য হয় (আমাদের নামোভাইই তো ২০১৪ সালে তা করে দেখিয়েছেন)। আর টাকা লাগলে গৌরী সেন-দের তলব করতেই হয়। ছোট গৌরি সেনেরা দশ বিশ লাখ দিলে, বড়রা দশ বিশ একশ কোটিতে আনাগোনা করেন। নারদের দেখানো ভিডিও তে তেমনই একটি (জাল) ছোট সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন নেতাকে চার পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু মুকুল রায়কে কুড়ি লাখ দেওয়া হয়, তবে সেটা ভিডিওতে ধরা পড়েনি। সাকুল্যে ৭৩ লাখ টাকা দেওয়ার ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কোম্পানি অবশ্য দাবী করেছে ওদের কাছ ৫২ ঘন্টার ফুটেজ আছে। সেখানে আরও নতুন কোনও লেনদেন-এর সন্ধান মিললেও মিলতে পারে।

প্রশ্নগুলো 

  • ২০১৪ সালে তোলা ভিডিও.২০১৬ বিধানসভা ভোটের আগে ব্যবহার করার কারণ কী? তখন কেন এগুলো প্রকাশ করা হয়নি? সংস্থা কীসের অপেক্ষায় ছিল?
  • নারদ নিউজ-এর ওয়েবসাইটে যে যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া আছে, তা দুবাই-এর। এটা খুবই সন্দেহজনক। মূলত ভারতের খবর সম্প্রচার করা কোনো নিউজ পোর্টাল কেন দুবাই থেকে চালিত হবে অনেক ভেবেও এর কোনও সদুত্তর পেলাম না।
  • নারদের পক্ষ থেকে যে টাকাটা ভিডিও তোলার স্বার্থে খরচ করা হয়েছে, সেই টাকা কোথা থেকে এল? সেই টাকার রঙ সাদা না কালো? এদের প্যাট্রন কে?
  • এমন একটা ভিডিও হাতে থাকা সত্ত্বেও কোনও আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে স্রেফ হুজুগ তৈরি করার চেষ্টা করার কারণ কী? সংস্থা অ্যান্টি-কোরাপশন এক্টিভিজম করতে চাইলে প্রিভেনশন অফ কোরাপশন অ্যাক্ট-এ এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। কিন্তু করেনি।
  • ভিডিওটা জনস্বার্থে করা, নাকি এই সংস্থাও কোনও বিশেষ সুবিধে পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এটা করেছে?
মাছের গন্ধ

২০১৪ সালে তৃণমূলের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়বে বলে যে দল প্ল্যান করেছিল, তার নাম বিজেপি। নিন্দুকে বলছে, এই ভিডিও তৈরির পেছনে বিজেপি-এর টাকা রয়েছে। অবশ্যই সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। এখন যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই, এটা বিজেপিরই কারসাজি, তাহলে আরেকটা প্রশ্ন মাথায় চলেই আসে। ২০১৬ বিধানসভা ভোটে তৃণমূল লুকিয়ে চুরিয়ে বিজেপি-এর হাত ধরেছে এমন খবরে/গুজবে বাজার সরগরম। তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যেও এই ধরণের ইঙ্গিত শোনা গেছে। লকেট টলিউডের সদস্য হওয়ার দরুন দিদি তাকে জিতিয়ে দিতে পারে, এমন কথাও শোনা গেছে। অবশ্য ভোটের বাজারে গুজব এবং স্পেকুলেশন থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি এই ভিডিও-এর পেছনে বিজেপি-এর ভূমিকা থাকে, তাহলে বিজেপি-এর সঙ্গে তৃণমূলের গোপন চুক্তির থিওরি বিশেষ কল্কে পাচ্ছে না।

কোনো পুরুষকে নেশা করিয়ে তার সঙ্গে কোনও মহিলার অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও করলে ভিডিও যারা তুলছে তাদের দিকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর অভিযোগ যেমন তোলা যায়, পুরুষটিকেও জ্ঞানত এই ঘটনায় অংশগ্রহণ করার জন্য দায়ী করা যায়। তৃণমূলের পক্ষ থেকে যারা অ্যাপলজিস্ট সেজে 'এমন তো হয়েই থাকে', 'সব দলই টাকা নেয়', ইত্যাদি বলবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, তাদের এটা মাথায় রাখা উচিৎ। মমতা ব্যানার্জি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো সৎ। হয়তো সত্যিই ঘুষ নেন না। হয়তো ওনার চটির দাম ৩৫০০ টাকা এটা গুজব। হয়তো ওনার ঘড়িটা আসলেই আম আদমির মতো দু হাজারি। হয়তো বিলাসব্যসনেও মহিলার বিশেষ আগ্রহ নেই। এসব কিছু হওয়া সত্ত্বেও একদল বোকা ঘুষখোর মানুষের নেত্রী হবার দায় এবং লজ্জা দুইই তাঁকে নিজের কাঁধেই বইতে হবে। 

হাতে যা রইল 

তৃণমূলের একটা বড় সুবিধে হলো, দলটার কোনও আইডিওলজি কিম্বা এজেন্ডা নেই, সিপিএম বিরোধিতা ছাড়া। সেটুকু অবশ্য তারা বেশ ভালোভাবেই দাঁতনখ বের করেই করে থাকে। জনগণেরও তৃণমূলের কাছ থেকে (বস্তুত কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেই) সততার প্রত্যাশা নেই, সে দিদি যতই 'সততার প্রতীক' শব্দবন্ধের ওপর জোর দিন না কেন। এর ফলে তৃণমূলের লাভের লাভ যেটা হবে, সাধারণ মানুষ, যারা উঠতে বসতে নাইতে খেতে বিভিন্ন দলের নেতা গুন্ডার চোখ রাঙানি খেয়ে এবং তাদের ভেট দিয়ে তুষ্ট করে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এই ৭৩ লাখি গল্পে সম্ভবত বিশেষ আমল দেবে না। টাকার অংকটা আরেকটু বেশি হলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হোত। বাংলার সুবিধাবাদী মিডিয়া কতদূর এবং কতদিন এই ভিডিও নিয়ে শোরগোল করবে, তাও নির্ভর করছে তৃণমূলের সঙ্গে তাদের 'আলোচনা'-এর ওপর। এছাড়াও, বিজেপি যদি দ্যাখে এই ভিডিও বাম-কং জোটকে বেশি মাইলেজ দিয়ে ফেলছে, তারাও নিজেদের কলকাঠি নাড়াচাড়া করা শুরু করে দিতে পারে। 

সারদার প্রভাব তো ভোটে পড়েনি, নারদের প্রভাব পড়বে কিনা দেখা যাক। আপাতত, এমন বসন্ত রাতে আলো জ্বালো বিছানাতে, থাকিও না সাতেপাঁচে, লুকায়ো ঠিকানা...

Monday, March 7, 2016

শিবরাত্রির সলতে

স্থান - কৈলাশ
শিবরাত্রির দিন দ্বিপ্রহর
শিবঠাকুর শুয়ে আছেন। দু পাশে নন্দী আর ভৃঙ্গি বাবাকে আগলে বসে। একজন বাতাস করছে আরেকজন কল্কে সাজছে।

শিবঠাকুর - আহ মা মাগো মরে গেলাম। এর কি শেষ নেই?
নন্দী - আর তো বাবা এই একটা দিনেরই ব্যপার। একটু সহ্য করে নিন বাবা।
শিবঠাকুর - হ্যাঁ রে ওদের প্রাণে কি দয়ামায়া নেই রে? এইভাবে...ওরে বাবারে বাবা একেবারে চেপে ধরেছে গো। এই যা তো তোদের মা কে ডেকে নিয়ে আয়
ভৃঙ্গি - আজ্ঞে বাবা মা তো এই সবে গেলেন। ওনারও তো সকাল থেকে কম ধকল যাচ্ছে না।
শিবঠাকুর - মোলো যা ওনার আবার কীসের ধকল শুনি?
নন্দী - ইয়ে মানে মায়ের হাত ব্যাথা হয়ে গেছে বাবা। একটু রসুন তেল গরম করে মালিশ করতে গেছেন।
শিবঠাকুর - বটে! ওই তেল নিয়ে আসতে বলে দে আসার সময়। আমাকেও যেন একটু করে দেয়। মালিশ।
ভৃঙ্গি - বলে আসছি বাবা।
নন্দী - বাবা
শিবঠাকুর - হুম
নন্দী - বলছি আমার আইডিয়াটা কেমন ছিল বাবা? অন্যবারের চেয়ে এবারে কষ্ট কম বোধ করছেন?
শিবঠাকুর - কীসের পিন্ডি কষ্ট কম বল দেখি! দু মিনিট পর পর খুলে ফেলে পালটে নতুন লাগাতে হচ্ছে। হ্যাঁ যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একটু আরাম। তা এই বেলুনগুলোকে মর্ত্যের লোকে কী বলে রে?
নন্দী - কন্ডোম
শিবঠাকুর - কন্ডেম?
নন্দী - না না বাবা। কন্ডেম কেউ কেউ করে বটে। কিন্তু নাম কন্ডোম। ডেম না, ডোম।
শিবঠাকুর- ডোম? সে তো অচ্ছুৎ! তার নামে বেলুন বের করেছে? আজব ব্যপার!
ভৃঙ্গির প্রবেশ
ভৃঙ্গি - মা বলে পাঠালেন উনি আসছেন একটু পরে
শিবঠাকুর - বেশ। বাতাস কর, বাতাস কর।

কয়েক ঘন্টা পর।
শিব আগের মতনই শুয়ে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অবসন্ন দেহ।

শিবঠাকুর - যাক বাবা এ বছরের মতো নিস্তার পাওয়া গেল। হ্যাঁ রে ভৃঙ্গী তোদের ওই ডোম বেলুনগুলো তো ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়, না রে?
ভৃঙ্গি - আজ্ঞে হ্যাঁ বাবা
শিবঠাকুর - তা কতগুলো জমল রে?
ভৃঙ্গি - আজ্ঞে বাবা তিন হাজার
শিবঠাকুর - তিন হাজার! এক দিনে? তা ওগুলো ফেলবি কোথায় রে?
ভৃঙ্গি - সে আমি ঠিক ফেলে আসব।
শিবঠাকুর - কোথায় শুনি?
ভৃঙ্গি - আজ্ঞে বাবা, জেএনইউ তে।

Thursday, February 25, 2016

আমার করের টাকায় যেখানে যা যা হয়

জে এন ইউ বিতর্ক চলাকালীন ইনফোসিস-এর এক প্রাক্তন হোমরা, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন আম আদমির ট্যাক্সের টাকায় পড়াশুনো করা ছেলেপিলের দল পড়াশুনো না করে আন্দোলন করলে তা আমি মোটে সহ্য করব না। ভাইলোগ, বলতেই হচ্ছে বক্তব্য মে দম হ্যায়। সত্যিই তো, আমার রক্ত ঘাম জল করা টাকা তো আর কারুর বাপের সম্পত্তি নয় যে তা নিয়ে ঝান্ডাবাজি করা হবে? তবে কিনা এই পোড়া দেশে, আমার আপনার ট্যাক্সের টাকায় বেড়াল পায়রার বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর প্রায় সবই হয়। কীরকম? আসুন কয়েকটা নমুনা দেখা যাক।

১। নেতার খাইখরচ - সরকারী তথ্য অনুযায়ী, সরকার এম এল এ পিছু প্রতি মাসে খরচ করে ২,৭০০০০ (দু লাখ সত্তর হাজার) টাকা। মাস মাইনে, দৈনিক ভাতা, কেন্দ্রের খরচ ছাড়াও, আছে বিনামূল্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, গাড়ির জ্বালানি, বাস ট্রেনের বিনা টিকিটে যথেচ্ছ যাতায়াতের সুবিধা, বছরে চৌত্রিশটা প্লেনের টিকিট, গোটা পরিবারের চিকিৎসার খরচ, ইত্যাদি। ৫৪৩ জন সদস্যের ট্রাভেল রিইম্বার্সমেন্ট-এ সরকারের বছরে খরচ ৮৩ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য এই দেশপ্রেমী সৈনিকদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা স্কুলের গন্ডিটুকুও পেরোননি। তাতে যদিও তাঁদের রাজনৈতিক যোগ্যতার বিচার হয়য় না, তবুও বলতে ইচ্ছে হলো তাই বললাম।
২। সামরিক খচ্চা - সেপ্টেম্বর ২০১৫ মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বিভিন্ন সামরিক খাতে সরকারের খরচ ২২৯০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাইনেকড়ি, খাওয়া দাওয়া, গোলা বন্দুক এসবের খরচ আছে।
৩। সি এস ডি ক্যান্টিন - দেশের যারা সেবা করেন, তাদের পালটা সেবা করতে সি এস ডি নামে একটি বস্তু আছে। সি এস ডি-র পুরো নাম হলো ক্যান্টিন স্টোর্স ডিপার্টমেন্ট। এই সি এস ডি কী করে? জলের দরে খাবার, মদ, টিভি ফ্রিজ, পাখা, জামা, জুতো, সুটকেস, সানগ্লাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন, গাড়ি, এসব বিক্রি করে সেনা, বায়ুসেনা, বিএসএফ, গান এন্ড শেল ইত্যাদি সামরিক-আধা সামরিক দপ্তরের কর্মচারিদের। ২০১০-১১ এর হিসেব অনুযায়ী সিএসডি ক্যান্টিনের জিনিস্পত্র কেনাকাটার জন্য সরকার বছরে ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে ক্যান্টিন প্রতি। এরকম ৩৪টা বড় ক্যান্টিন আছে সারা দেশে। সেইসব ক্যান্টিনের অধীনে আবার আরও অনেক ক্যান্টিন। এই নীচুতলার ক্যান্টিন ৪-৫% দাম বাড়িয়ে কর্মচারীদের তা বিক্রি করে। এই যে বাড়তি ৪-৫% মুনাফা, তার কী হয় কেউ জানে না। উল্লেখযোগ্য, সিএসডি-এর কোনও অডিট হয় না। আমার আপনার চেনা অনেক মদ স্মাগলার আছে, যারা ১৮০০/- টাকার মদ ১৩০০/- টাকায় বেচে। জানবেন তারা বিভিন্ন দেশভক্ত সামরিক কর্মচারীর বদান্যতায় ৭০০-৮০০ টাকায় সেগুলো কেনে।
৪। প্রজাতন্ত্র দিবস - ২০১৪ সালে সাজুগুজু করে মন্ত্রী সান্ত্রী লেঠেল বাগিয়ে, অস্ত্রাগার খুলে প্রতিবেশির মনে ভয় আর দেশবাসীর মনে ভক্তির সঞ্চয় করতে যে চার ঘন্টার লাচ প্ররিবেশিত হয়েছিল নিয়মমাফিক রাজপথে, তাতে সরকারের খরচ হয়েছিল ৩২০ কোটি টাকা
৫। বিবিধ - এই যে যিশু ঠাকুর জন্মেছিলেন বলে গোটা পার্ক স্ট্রীট আলোর মালায় সেজে ওঠে, আচমকা শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের নাম পালটে শোভাবাজার সুতানূটি করায় স্টেশনের সব নিয়ন বোর্ড পালটে ফেলতে হয় রাতারাতি, অমুক তমুককে সম্বর্ধনা দিতে হয় সোনার মুকুট মেডেল দিয়ে, বিজয় মাল্যকে লোন পাইয়ে দিতে হয় যাতে ষাট নম্বর জন্মদিনটা হেব্বি কেতায় গোয়ায় পালন করতে পারেন, এসবই ভাইয়ো বেহেনো আমাদের টাকায় হয়। আর ওই যে স্মৃতিজি ওনার আগুন ভাষণে বললেন না, ওনার কোটায় কাদের কাদের ক্যান্ডিডেটকে সীট পাইয়ে দেন? হ্যাঁ ওসবও হয়। জাতীয় কোটায় পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে না পেলেও, মন্ত্রীর কোটায় বড়লোকের ৪০% পাওয়া ছেলেমেয়েও দিব্যি ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়তে পারে।

সরকারের কী ভাগ্যি বলুন তো! আমার আপনার মতো বেহেড গবেটে দেশটা ভরে গেছে বলেই না ঘাস বিচুলি যা পারে খাইয়ে দেয় আর আমরাও পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জাবর কাটতে থাকি।

Tuesday, February 9, 2016

জাতপাত সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি আগেই জানতাম কিন্তু বলিনি


দলিত-নিগ্রহ বা 'নিচু' জাতের লোকজনকে অহেতুক হ্যাটা করার দৃশ্য আমি সত্যিই কোনদিন দেখিনি। দেখবই বা কিকরে? আমার আত্মীয়স্বজন-এর যাদের বেছে নেবার কোনও অপশন আমার কাছে ছিল না, প্রত্যেকের পদবী মোটামুটি - ব্যানার্জী, মুখার্জি, ব্যানার্জী, ব্যানার্জী, মুখার্জি, ভট্টাচার্য, রায়, গোস্বামী, বসু...পেয়েছি পেয়েছি একজন বসু আছে। হ্যাঁ আমার এক মাসতুত দিদির বরের পদবী বসু। নামের শেষে বসু আছে এমন একজনকে মেয়ে বিয়ে করবে মনস্থ করেছে শুনেই মাসি শয্যা নিয়েছিলেন। বহুদিন কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত কায়স্থ জামাইয়ের মুখদর্শন করেননি। জীবনের শেষ দশ বছর অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁকে এই বসু পরিবারের সঙ্গেই এক বাড়িতে কাটাতে হয়। সে যাকগে যাক। এবারে আসা যাক আমার বন্ধু তালিকায়। অর্থাৎ যাদের আমি যেচে আমার জীবনের অংশ করেছি। তাদের পদবীগুলো মোটামুটি এইরকম - ব্যানার্জী, চক্রবর্তি, ভট্টাচার্য, পাল, গুহ, দত্ত, দাশগুপ্ত, নাথ, মুখার্জি, অধিকারী, বিশ্বাস, বসু, রায়চৌধুরী, ব্যানার্জী, গাঙ্গুলি, মন্ডল, মিত্র, কর্মকার, সরকার, আগরওয়াল, পান্ডে, নারায়ানন, বাগ, লাহিড়ি, চৌধুরী, রায়, চ্যাটার্জি। হ্যাঁ এক দু পিস বাদে সবই সৎ ব্রাহ্মণ। নিদেনপক্ষে কায়েত। আমি বেছে বেছে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গেই দোস্তি পাতিয়েছি এমনটা ভাবতে প্রথমটায় খুব আত্মগ্লানি বোধ হলো। তারপর সেটা খন্ডাতে একটা অকাট্য যুক্তি বের করলাম। এই যে সব বন্ধুবান্ধবের দল, এদের আমি পেলাম কোথায়? কাউকে স্কুলে, কাউকে কলেজে, কাউকে ইউনিভার্সিটিতে, কাউকে অফিসে, কাউকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। এই মোটের ওপর বন্ধু কালেকশনের ঠেক। এবারে বন্ধুত্ব পাতাতে গেলে তো আর আমি পদবী দেখে পাতাইনি? পালকের রঙ দেখে পাতিয়েছি। এখন এইসব জায়গায় যে আমি বেশি বেশি করে 'নিচু' জাতের মানুষ খুঁজে পাইনি, বা বলা ভালো প্রায় সবই বর্ণহিন্দু পেয়েছি তার দায় কি আমার, না আমার পূর্বপুরুষের না বেদের না সংবিধানের শুনি?


লক্ষ্মী'র পদবী আমি জানিনা। লক্ষ্মী বিহারি। পৌরসভার ঝাড়ুদারনি। সপ্তাহে একদিন ফ্রি ল্যান্স আমার বাড়ির দুটো বাথরুম আর ড্রেন পরিষ্কার করে দিয়ে যায় সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। এছাড়া রোজ আমার বাড়িতে ওর কাজের ব্যাগটা রেখে যায়। ডিউটি শেষ করে ফেরার সময় তুলে নিয়ে যায়। লক্ষ্মী আমার মা কে 'মা' আর আমাকে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে। আমি দরজা খুলে দাঁড়ালে এক অদ্ভুত কায়দায় টুক করে 'ও যেন আমাকে টাচ না করে' স্টাইলে ভেতরে ঢুকে যায়। আর মাসের শেষে টাকা নেবার সময় দু হাত জড়ো করে আঁজলা পেতে দাঁড়ায়। আমি কিন্তু ওকে এসব করতে শেখাইনি। শুনেছি পৌরসভার কর্মী হবার সুবাদে ওরা এখন খুব খারাপ মাইনেকড়ি পায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার, অঞ্চলে বহু অশিক্ষিত বেকার বামুনের ছেলেমেয়ে থাকলেও তারা কেউ কক্ষনো এই কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করে না। বামুনের ছেলে হয়ে দেবুদা মাথায় করে মাছ ফেরি করে বেড়াত বলে পাড়ায় ঘোর বদনাম হয়েছিল।


বাবার মুখে শুনেছি বাবা যখন ছোট ছিল খুবই কিউট বাচ্চা ছিল আর এ ও সে এসে চটকে দিত, বিস্কুট লজেন্স দিত। একটা বুড়ো লোক ছিল যাকে আমার বাচ্চা বাবা নাম ধরে ডাকত আর সে আমার বাবার দেখা পেলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। বামুনের ছেলেকে প্রণাম করলে পুণ্যি হয়।


আমার এক কাকা আক্ষেপ করে একদিন বলেছিল, সমস্ত রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের নাম আজকাল সোনার চাঁদ সোনার টুকরো। হ্যাঁ সে ট্রেনে যেতে যেতে নজর রাখে স্টেশন মাস্টারের নামফলকের দিকে - পদবী দেখবে বলে।

আশা করছি এতসব স্বীকারোক্তির পরে আমাকে কেউ আর বর্ণহিন্দু বলে গাল পাড়বেন না। পাড়লেও ভারি বয়ে গেছে। কয়েকমাস পরেই আমার তুতো দিদির ছেলের পইতে। তখন কবজি ডুবিয়ে খাব। আর ব্রহ্মচারী দন্ডিঘরে থাকাকালীন তার চোখ যেন কোনও অব্রাহ্মণের দিকে না যায় সেই ব্যবস্থা করব। জয় গুরু!

Thursday, December 31, 2015

শব্দকোষ

রোজ সকালে বাড়ির উঠোনে একটা নিচু পিঁড়িতে বসে বড় জেঠিমা কুলোয় করে চাল ঝাড়ত। চালের একটা পড়ত কুলো থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে আবার নেমে আসত ঝিপ ঝিপ শব্দের তালে তালে। চাল থেকে বেছে রাখা খুদকুঁড়ো জমা করে রাখা হত একটা পুরনো দালদার টিনে। জেঠু মুঠো ভরে সেগুলো ছন ছন করে রকে ছড়িয়ে দিতেই ঝটাপট হুম হুম বক বক বকম বকম শব্দ তুলে গোলা লোটন গেরোবাজের দল রান্নাঘরের টালির চাল থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে কংক্রিটে টুক টুক করে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে নিমেষে সাবড়ে দিত সব। মার্ফি রেডিওটা খড়বড় খড়বড় করে উঠে বলত 'বিবর্তনের পথে মানুষ'...। বাগানে দুটো ইঁটের ফাঁকে শুকনো ডালপাতা সাজিয়ে ফস করে দেশলাই জ্বেলে ঠাকুমা এক হাঁড়ি চানের জল চাপিয়ে বসে থাকত একটু দূরে। চটপটমড়মড় করে জ্বলে ওঠার খানিক পরেই এলুমিনিয়াম হাঁড়ির জল টগবগটগটব করে ফুটে উঠে উথলে গিয়ে ফ্যাঁসসস করে আগুন নিভিয়ে দিত। ছোটকাকা অ্যাল্লল্লল্লল্লল্ল গ্লল্লল্লল্ল গ্লাগগ্লাগগ্লাগ পুচুক করে সাড়া বাড়ি জানিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলত উঠোনের কলে। দাদুর খুরপি খুপ খুপ করে গাছের তলার মাটি আলগা করত। ঠুং করে জানান দিত মাটিতে মিশে থাকা ইঁটের টুকরোর খবর। উপুড় করে রাখা স্টীলের গ্লাসটা তুলে কুঁজোর গলার কাছটা ধরে নামিয়ে আনতেই বগবগবগবগ শব্দে জল বেরিয়ে এসে ভরিয়ে দিত গ্লাসের ফাঁদ। পাথরে নরুন ঘষার শব্দ ছিল। ছোট পেতলের হামানদিস্তায় পান ছাঁচার শব্দ ছিল। জাঁতিতে সুপুরি কাটার শব্দও...
যেসব শব্দেরা ছোটবেলা ঘিরে ছিল তাদের অনেকগুলোই আজ আর নেই।

নতুন শব্দেরা এক এক করে জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। শিলনোড়ার শব্দের বদলে মিক্সির শব্দ, খাতায় পেন ঘষার শব্দের বদলে কীবোর্ড টেপার শব্দ। গ্র্যান্ডফাদারের ঢং ঢং থেকে অজন্তা ঘড়ির টুংটাং। ক্রিরিরিং ক্রিরিরিং থেকে পলিফোনিক থেকে এমপিথ্রি। এই ঘুর্ণায়মান শব্দটানেলের ভেতর দিয়ে যতই এগিয়ে চলেছি পেছনে একের পর এক দরজার নিঃশব্দ বন্ধ হওয়া টের পেতে পেতে, মস্তিষ্কের ক্রমবর্ধমান ভার স্মৃতির পায়রাখোপে ঠুসে দিতে থাকে দৈনন্দিনতার সাদামাটা মূর্ছনা।

রাতের হুল্লোড়ঘোর কাটিয়ে নতুন বছরের সকালে চোখ খোলার আগেই পাশের বাড়ির ঝপাস জল ঢেলে খ্যাংরা কাঠির ঝাঁটার খর খর ছপাস খর খর ছপাস শুনলেই বুঝব, মাংসের ভেতরে লাব ডুব লাব ডুব ছন্দে বয়ে চলা রক্ত, ক্যালেন্ডারকে থোড়াই কেয়ার করে।